রহিম আব্দুর রহিম :

’৭১এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সুফল জাতি ভোগ করছে। ৭ মার্চের ব্রজকন্ঠে উজ্জ্বীবিত জাতির একটি অংশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমরযুদ্ধে লাখো প্রাণ শহীদ হয়েছেন। সন্তান হারা পিতা-মাতা, স্বামী হারা স্ত্রী, পিতা-মাতা হারা লাখো মানুষের শান্তি একটাই; দেশ আজ স্বাধীন। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমাদের যেমন বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে, তেমনি রয়েছে যৌক্তিক চাওয়া-পাওয়ার অধিকার। স্বাধীন দেশের জনগণ তার সরকারের কাছে যৌক্তিক যে কোন দাবী পেশ করতেই পারে। কোন যৌক্তিক দাবী আন্দোলনের বিষয়টিকে অন্ধভাবে ষড়যন্ত্র বলা ঠিক নয়। আবার আন্দোলনকে পুঁজি কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, তাদের নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য কোন ফাঁদ পাতার চেষ্টা করে, তবে ওই,গোষ্ঠী বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদেরই অবস্থান নেওয়া উচিত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে শিখিয়েছেন, যেকোন অন্যায় বৈষম্যের বিরুদ্ধেই আমাদের আন্দোলন। তিনিই উদ্বুদ্ধ করেছেন যৌক্তিক দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফেরা নয়। তাঁরই অনুপ্রেরণায় আজ আমরা স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের নাগরিক।

স্বাধীন দেশে কোটা পদ্ধতি চালু রাখার মূলমন্ত্র পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোতধারায় শামিল করা। এক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের যে কোটা রাখা হয়েছে, তা পুরোপুরি কৃতজ্ঞতা স্বীকার এবং মহান মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মকে কৃতজ্ঞতার ইতিহাসে সম্পৃক্ত করা। পৃথিবীর কোন দেশেরই মুক্তিকামী সৈনিক বা মুক্তিযোদ্ধাদের সেই দেশের সরকার বিন্দুমাত্র সুযোগ সুবিধা দেন নি । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একমাত্র বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত সরকারই মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকুরীতে ৩০ শতাংশ কোটার প্রচলন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার পর চাকুরির ক্ষেত্রে যে বয়স প্রয়োজন ওই বয়সের মুক্তিযোদ্ধা যেমন পাওয়া মুশকিল, তেমনি সকল ক্ষেত্রেই শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পন্ন মুক্তিযোদ্ধা মেলানো দুষ্কর। যার কারনে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শেখ হাসিনা সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩ শত টাকা সম্মানী ভাতা এবং চাকুরি ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য কোটা পদ্ধতি চালু করেন। ৩শত টাকার ভাতা বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাটাগরী অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার থেকে সর্বনিম্ন ১০ হাজার পর্যন্ত প্রদান করা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এই সরকারের এই সম্মানবোধ শুধু প্রশংসার দাবী রাখে না, যা চিরস্মরনীয়ও বটে। সরকারের চালু করা কোটা পদ্ধতিতে মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য ৩০ শতাংশ, জেলা কোটা, ১০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠী ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ। সব মিলিয়ে ৫৬ শতাংশ চাকুরি কোটার আওতায় পড়েছে। বাকি ৪৪ শতাংশ চাকুরি পাচ্ছে সাধারণ মেধা কোটায়। কোটা পদ্ধতিতে চাকুরির বিষয়টি শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই রয়েছে। কারণ, বৈষম্য দূর করা, পিছিয়ে পড়াদের মূলধারায় তুলে আনা। তবে বৈষম্য দূর করতে গিয়ে যেন আবার বৈষম্য সৃষ্টি না হয় সেটাও সময়ের ব্যবধানে দায়িত্বশীলদের ভাবতে হবে। বিভিন্ন কোটায় যদি ৫৬ শতাংশ হয় তবে সাধারণ মেধায় ৪৪ শতাংশ, এখানেও একটা বৈষম্য বিরাজ করছে। সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনটি ব্যাপক জনপ্রিয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। এ আন্দোলনকে ঘিরে কাঁদা ছোড়াছুড়ি, ষড়যন্ত্রের অভিযোগ, রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টাও কম হচ্ছেনা। কোটা সংস্কার আন্দোলনে এ যাবৎ যা কিছু ঘটেছে তার কোনটাই শুভ নয়। সবকিছুর মধ্যেই ফাঁরাক, অপরাধ, রাজনৈতিক চাতুরতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়িত্বশীলদের অতিউৎসাহী কর্মকান্ড, আবেগ এবং ক্ষোভের বহি:প্রকাশও ঘটেছে।

আন্দোলনকারীরা চেয়েছিল কোটার সংস্কার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে অভিমান করে বলেছেন, ‘কোটা সংস্কার করে লাভ কি, আবারও আন্দোলন হবে, তার চেয়ে কোটার দরকার নাই। তিনি পরক্ষনেই বলেছেন, পিছিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠী কিংবা বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের জন্য প্রয়োজনে কোটা ছাড়া অন্য কিভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করে চাকুরি দেওয়া যায় সে বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।’ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়েছে, তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে যৌক্তিক মনে করেছেন তবে সংস্কারের নামে বারবার যেন আন্দোলন না হয়, এটা তিনি চেয়েছেন। তবে পিছিয়ে পড়ার গোষ্ঠীর জন্য বলবৎ রাখা শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয় একেবারেই মানবিক। প্রধানমন্ত্রী আবেগ, ক্ষোভ প্রকাশ করার কারণ, আন্দোলনকারীদের কাছে সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিনিধি পাঠানোর পরও আন্দোলনকারীরা তা শুনেনি, আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর আন্দোলনকারীরা, কোটা সংস্কার বা বাতিল হোক, এ দাবীটিকে পেছনে রেখে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবী তুলতে পারতো, তবে আন্দোলনটি পরিপক্ক বলে মনে হতো। তা তারা করেনি, আনন্দে আত্মহারা আন্দোলনকারীরা পরদিন বিশাল সমাবেশ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘মাদার অব ইডুকেশন’ উপাধিতে ভূষিত করে স্লোগান দিয়েছে। এ ধরনের কর্মকান্ডে আন্দোলনকারীরা দেশবাসীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, তারা কেউ রাজাকার, শিবির, জামায়াত, বিএনপি, জাসদ, বাসদ, আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ নয়। একেবারেই সব দল-মতের উর্দ্ধে থেকে নতুন প্রজন্ম, তাদের সমষ্টিগত একটি দাবী প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া উপাধির পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা সমালোচনা হতেই পারে। উপাধির গুরুত্ব বর্তমানে নাও থাকতে পারে। শত বছর পরে এই উপাধি, শেখ হাসিনার কর্মময় জীবনের ইতিহাসে জায়গা করে নিবেই এতে কোন সন্দেহ নেই। আজ যারা আন্দোলনকারীদের জামায়াত, শিবির, কুলাঙ্গার কিংবা অন্য কিছু ভাবছে; তারাও বিষয়টির গভীরে পৌঁছতে পারে নি।

শাহবাগে আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্রদের উপর পুলিশের যে অ্যাকশন, এই অ্যাকশনের যৌক্তিকতা কতটুকু? সাধারণ ছাত্রদের ক্ষেপিয়ে তোলার কারনে একটি যৌক্তিক আন্দোলনের ইস্যুটি রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় কি না? তা পুলিশের উর্দ্ধতন মহলের ভাবা দরকার ছিল। ্অতি উৎসাহী কর্মকান্ড দেশ জাতির মঙ্গল বয়ে আনে না। আন্দোলন মাঠে রেখে, গভীর রাতে ভিসির বাড়িতে যারা তান্ডব চালিয়েছে তারা যে ‘৭১ এর প্রেতাত্মা; এতে কোন সন্দেহ নেই। ভিসির বাড়ির লুটতরাজ, ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াও সবকিছুই পরিকল্পিত। এধরনের কর্মকান্ডের মূলে ছিল সরকার পতনের এক গভীর ষড়যন্ত্র। এটা বুঝতে পেরেছিলেন ভিসি। এর প্রমাণ, ভয়াবহ তান্ডবের সময় তিনি পুলিশ খবর দেন নি। তাঁর স্ত্রী যখন তাকে পুলিশ খবর দিতে বলেছেন, তখন তিনি দায়িত্ববান ব্যক্তির পরিচয় দিয়েছেন । তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেছেন পুলিশ আসলেই লাশ পড়বে। হ্যাঁ, এ আন্দোলনকে ঘিরে একটি লাশ কামনা করেছিল ষড়যন্ত্রকারী অশুভ শক্তি ! কিন্তু তা হয়নি।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে জামায়াত, বিএনপি কিংবা কোন রাজনৈতিক দলের আন্দোলন নয়, তবে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা জামায়াত, বিএনপি, জাসদ, বাসদ, আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ বা অন্য কোন রাজনৈতিক দলের আদর্শে বিশ্বাসী হতেই পারে। অর্থাৎ আন্দোলনটি সর্বদলীয় তারুন্যের। কোটা বিলুপ্ত হোক এটা কেউ চায় না । তবে সংস্কার হোক, এটা সবারই কাম্য, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতী-পুতিদের জন্য যে কোটা রাখা হয়েছে তার যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছি না। ধরুন, আমি মুক্তিযোদ্ধা, আমার সন্তান মুক্তিযোদ্ধার কোটায় পড়েছে। আমার নাতী বিয়ে করেছে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার বা পিস কমিটির এক নাতীকে, এখন আমার নাতী যদি মুক্তিযোদ্ধার কোটায় পড়ে থাকে, তবে রাজাকার বা পিস কমিটির ওই নাতি কোন কোটায় পড়বে? অর্থাৎ নাতী-পুতির কোটা চিরতরে বিলুপ্ত করা, যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হবে বলে অনেকেই মনে করছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা নির্ণয় করে তাদের নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে যেমন ইতিহাস বিনির্মাণ সময়ের দাবী, তেমনি স্থানীয়ভাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের বংশপরিচয় সম্বলিত একটি ডকুমেন্টরি সংরক্ষণ করাও রাষ্ট্রের প্রয়োজন। আজ না হোক, শত বছর পরে হলেও স্বাধীনতার পক্ষ এবং বিপক্ষদের তালিকা স্থানীয়ভাবে ভাবী প্রজন্ম গ্রহণ করতে পারবে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বর্তমান সরকারকেই কিছু করে যেতেই হবে; এ দাবী সর্বস্তরের। এক্ষেত্রে সকল প্রকার মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য এককালীন হ্যান্ডসাম অর্থসম্পদ প্রদান করা, অর্থাৎ যে সম্পদ তার কয়েক পুরুষ স্বচ্ছলভাবে ব্যবহার করতে পারবে একই সাথে সকল মুক্তিযোদ্ধা পরিবারদের স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করাও যেতে পারে। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভাতা প্রদান করছেন তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এই ভাতা নিয়েও একসময় মহাবিরোধ সৃষ্টি হবে এটাই নিশ্চিত। ধরুন, আমি মুক্তিযোদ্ধা, আমি ভাতা পাচ্ছি, আমি মারা যাওয়ার পর এই ভাতা আমার স্ত্রী পাবে, স্ত্রী মারা যাওয়ার পর এই ভাতা কে পাবে, ছেলে পাবেন, নাকি মেয়ে পাবেন ? ধরে নিলাম ছেলে-মেয়েরা ভাগ-বাটোয়ারা করে পাবেন। ছেলে-মেয়েরা মারা যাওয়ার পর এ ভাতা কে পাবে, মেয়ের ঘরের নাতী, নাকি ছেলের ঘরের নাতী ? এ ধরণের বহু তর্ক-বিতর্ক, দাবী-দাওয়া পারিবারিক কলহ-বিরোধ একসময় কোট-কাচারীতে গিয়ে ঠেকবে। অমিমাংসীত বিষয়টি, শত শত বছর ঝুলে থাকায় রাষ্ট্রের বরাদ্দকৃত কোটি কোটি টাকা অলস পড়ে থাকলে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কি হতে পারে? তাও আমাদের ভাবা উচিত।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে মুক্তিযোদ্ধাদের এককালীন ব্যবস্থা সরকার করতে পারে এবং চাকুরি ক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের জন্য পাঁচ বছর মেয়াদী ১০ শতাংশ কোটা রাখা যায়। জেলা কোটা অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদী ১০ শতাংশ রাখা অবশ্যই প্রয়োজন। নারী কোটা ১০ শতাংশ পরিবর্তন করে ১৫ শতাংশ করা বাঞ্চনীয়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ৫ শতাংশের জায়গায় ১০ শতাংশ এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন (প্রতিবন্ধীদের) ১ শতাংশের জায়গায় ৫ শতাংশ অর্থাৎ বৈষম্যহীন ৫০ শতাংশ কোটা, বাকি ৫০ শতাংশ সাধারণ মেধায় রাখার যৌক্তিকতা অবশ্যই রয়েছে। কারণ মেধাবীদের সাথে কোটার পর্যাপ্ত বৈষম্য ঘটলে মেধা পাচার হয়ে যেতে পারে। এতে করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পর্যাপ্ত ক্ষতি হবে। পূর্বের কোটায় যেমনটি ছিলো, কোটা না পাওয়া গেলে মেধাবী দ্বারা তা পুরণ করা হয়েছে। নতুন সংস্করনে নিজ জেলায় কোটা পুরণ না হলে, পাশ্ববর্তী জেলা থেকে কোটা পুরণ, পাশ্ববর্তী জেলাতেও কোটা পুরণ না হলে পরবর্তীতে সাধারণ মেধা তালিকা থেকে তা পুরণ করার মত নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কি না বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখতে পারেন।

লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিক্ষক

মোবাইল: ০১৭১৪-২৫৪০৬৬

ই-মেইল: ৎধযরসধনফঁৎৎধযরস@যড়ঃসধরষ.পড়স